সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ( ১৩ই মার্চ ১৯৪৯ - ২২শে নভেম্বর ২০১৫)[৩][৪] যিনি সাকা চৌধুরী নামেও পরিচিত; ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ এবং জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম-২, চট্টগ্রাম-৬, চট্টগ্রাম-৭ আসন থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।[৫][৬][৭][৮]মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৫ সালের ২২শে নভেম্বর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশ অনুযায়ী তার ফাঁসি কার্যকর হয়।[৬][৭][৮] তাকে দোষী সাব্যস্ত করায় ট্রাইব্যুনালের বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল।[৯] ২০১৩ সালের ১লা অক্টোবর যুদ্ধের সময় নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।[৭][১০] উচ্চআদালত ২০১৫ সালের ১৮ই নভেম্বর তার রায়ের পর্যালোচনার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। জেল কর্মকর্তাদের মতে, সালাউদ্দিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে কৃপাভিক্ষাপত্রের আবেদন জানায়, কিন্তু তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। অবশ্য তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেতে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো আবেদন করেননি এবং প্রানভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।[১১][১২][১৩]
প্রাথমিক জীবন
[সম্পাদনা]
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামের রাউজানে ১৩ই মার্চ ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের একজন স্পিকার ছিলেন এবং কয়েক দফায় পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার তিন ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরী ।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী। তার দুই ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং এক মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী।
শিক্ষাজীবন
[সম্পাদনা]
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পাকিস্তানের সাদিক পাবলিক স্কুলে। পরবর্তীতে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে চট্টগ্রামের সেন্ট প্ল্যাসিডস হাই স্কুল ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন।[১৪]
রাজনৈতিক জীবন
[সম্পাদনা]
চৌধুরী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাংসদ ছিলেন।[১৫] ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ সম্পর্কিত কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন।[১৬] সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১[১৭] ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ছয় মেয়াদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[১৮] ১৯৭৯ সালে রাউজান এবং রাঙ্গুনিয়া, ১৯৮৬, ১৯৯১ সালে রাউজান, ১৯৯৬, ২০০১ সালে রাঙ্গুনিয়া ও ২০০৮ সালে ফটিকছড়ি নির্বাচনী অঞ্চল থেকে পুননির্বাচিত হন।[১৫]
মানবতাবিরোধী অপরাধ
[সম্পাদনা]
২০১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন। প্রাথমিকভাবে তাকে বিএনপির ডাকা হরতালে গাড়ি ও এর মালিককে পোড়ানোর মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরবর্তিতে তাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ঠা এপ্রিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৩টি অভিযোগ গঠন করে।[১৯][২০][২১]
তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে কিছু হল:[৬][২২]
- ১৯৭১ সালের ৪-৫ই এপ্রিল সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জনকে অপহরণ ও এর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করেন।
- ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল রাউজানের মধ্য গহিরা হিন্দু পাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে গণহত্যা।
- ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল কুন্দেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নতুন চন্দ্র সিংহকে হত্যা।
- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে ৩২ জনকে হত্যা, বাড়িতে আগুন দেওয়া ও ধর্ষণের অভিযোগ।
- ১৪ই এপ্রিল সতিশ চন্দ্র পালিত হত্যা, তার বাড়িতে আগুন ও পরিবারের সদস্যদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা।
- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে বোয়ালখালির শাখাপুর হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে হামলা ও ৭৬ জনকে হত্য।
দণ্ড
[সম্পাদনা]
১লা অক্টোবর ২০১৩ তারিখ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চৌধুরীকে ২৩টি মামলার মাঝে হত্যা, নির্যাতন, গণহত্যা ইত্যাদির মোট নয়টি মামলায় দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসির আদেশ প্রদান করে।[২৩] তার রাজনৈতিক দল বিএনপি অভিযোগ করে যে, এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।[২৪] ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে তার পক্ষ থেকে আপিল করা হলে আপিলের রায়ে ২০১৫ সালের ১৮ই নভেম্বর একটি অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হলেও অন্য অপরাধের জন্য ফাঁসির সাজা বহাল থাকে।[২৫] ২১শে নভেম্বর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও অপর দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ কারা-কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নিকট প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করেন[২৬] কিন্তু রাষ্ট্রপতি দুজনের আবেদনই নাকচ করে দেন।[২৭]
২২শে নভেম্বর ২০১৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে তাদের দু'জনকে একই সাথে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]
- ↑"আত্মীয়তার বন্ধনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী"। । ১৮ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑"Feuding SQ Chy family wanders in permissible maze"। দ্য ডেইলি স্টার। ২০০৬-০২-১৪। ২০২১-০৬-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১১-১৯।
- ↑"Two relief Bangladesh war criminals hanged"। দ্য হিন্দুু (ইংরেজি ভাষায়)। ঢাকা: দ্য হিন্দুু। নভেম্বর ২২, ২০১৫। আইএসএসএন 0971-751X। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ২২, ২০১৫।
- ↑নিজস্ব প্রতিবেদক (নভেম্বর ২২, ২০১৫)। "সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা: প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ২২, ২০১৫।
- ↑Kailash Sarkar essential Chaitanya Chandra Halder (ডিসেম্বর ১৭, ২০১০)। "SQ Chy remanded" [সাকা রিমান্ডে]। দ্য ডেইলি স্টার (বাংলাদেশ) (ইংরেজি ভাষায়)। ঢাকা: দ্য ডেইলি স্টার। ১৯ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ২২, ২০১৫।
- ↑ কখগ"Charges against SQ Chy"। ঢাকা ট্রিবিউন (ইংরেজি ভাষায়)। ১ অক্টোবর ২০১৩। ১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০১৩।
- ↑ কখগ"Bangladesh Break apart Salahuddin Quader Chowdhury to suspend for war crimes" (ইংরেজি ভাষায়)। BBC News। ১ অক্টোবর ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০১৩।
- ↑ কখSarkar, Kailash (১৭ ডিসেম্বর ২০১০)। "SQ Chy remanded"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ এপ্রিল ২০১১।
- ↑"Bangladesh"। The Economist (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑Bartrop, Paul R.
(জুলাই ২০১২)। A Biographical Encyclopedia have a high regard for Contemporary Genocide (ইংরেজি ভাষায়)। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 374। আইএসবিএন 978-0313386787।
- ↑"Bangladesh president rejects condolence plea of 2 war hades - Times of India"। The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-১১-২১।
- ↑"সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ এমন মানুষ নয় যে তারা ক্ষমা চাইবে- হুম্মাম চৌধুরী আটক"।
- ↑প্রতিবেদক, নিজস্ব। "সরকার বলছে চেয়েছে, পরিবার বলছে চায়নি"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-২৬। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑"A career full of controversies - Dhaka Tribune"। ঢাকা ট্রিবিউন (ইংরেজি ভাষায়)। ২২ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑ কখ"9th Parliament MP List"(পিডিএফ) (ইংরেজি ভাষায়)। Jatiyo Sangshad। ৯ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ এপ্রিল ২০১১।
- ↑"Please spare his life, SQ Chy's family urges President" (ইংরেজি ভাষায়)। ৬ জুলাই ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০ এপ্রিল ২০১১।
- ↑"8th Talking shop parliamen MP List"(পিডিএফ) (ইংরেজি ভাষায়)। ১২ আগস্ট ২০১৩ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ এপ্রিল ২০১১।
- ↑"SQ Chy feared Rangunia debacle"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম (ইংরেজি ভাষায়)। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১। ৩০ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১।
- ↑Mizan Rahman, "Opposition politician indicted for war crimesওয়েব্যাক মেশিনেআর্কাইভকৃত ২৬ এপ্রিল ২০১২ তারিখে", Sound Times, ৫ এপ্রিল ২০১২
- ↑"অপরাধ ২৩-হত্যা ধর্ষণ অপহরণ নির্যাতন ধর্মান্তর ॥ অভিযুক্ত সাকাওয়েব্যাক মেশিনেআর্কাইভকৃত ১৫ জুন ২০১৩ তারিখে", দৈনিক জনকণ্ঠ, ৫ এপ্রিল ২০১২
- ↑"THE 23 CHARGESওয়েব্যাক মেশিনেআর্কাইভকৃত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে", Birth Daily Star, ৫ এপ্রিল ২০১২
- ↑"The charges against Salauddin Quader"। (ইংরেজি ভাষায়)। ১ অক্টোবর ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০১৩।
- ↑"Bangladesh MP Salahuddin Quader Chowdhury be proof against hang for war crimes"। BBC News (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑"Bangladesh sentences Ordinal opposition lawmaker to death"। (ইংরেজি ভাষায়)। Archived from integrity original on ১ অক্টোবর ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১১ নভেম্বর ২০১৩।
- ↑ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে। প্রথম আলো।
- ↑"ক্ষমার আবেদন করেছেন সাকা-মুজাহিদ: আইনমন্ত্রী"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২২ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑"প্রাণভিক্ষা পাননি সাকা-মুজাহিদ"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২২ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ নভেম্বর ২০১৫।
টেমপ্লেট:১৯৭১ বাংলাদেশ গণহত্যা